শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পূর্বাহ্ন
ঋতুচক্রের পরিক্রমায় ষড় ঋতুর মধ্যে বর্ষা দ্বিতীয়। গ্রীষ্মের পরেই বর্ষার আগমন।ঋতুচক্রের পাঁচটি ঋতু থেকে বর্ষা একেবারে আলাদা,এবং এর স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সুস্পষ্ট। এ ঋতু অন্য ঋতুর মতো চুপিসারে আসে না।বরং এ ঋতুর আগমন বেশ উদ্দাম,উচ্ছ্বাস এবং আড়ম্বরপূর্ণ। ঋতুচক্রের হিসেবে আষাঢ় – শ্রাবণ দুমাস বর্ষাকাল চিহ্নিত হলেও বর্ষার আগমন আরো আগেই ঘটে যায় এবং চলে যায় বেশ দেরি করে অর্থাৎ জৈষ্ঠ্যমাসের মধ্যে শুরু হয়ে চলে আশ্বিন মাস পর্যন্ত।বাংলা সাহিত্যে বর্ষার ব্যাপক অবদান অনস্বীকার্য।এ সময় আকাশে সারাক্ষণ চলে ঘনকালো মেঘের আনাগোনা। বর্ষা ঋতুকে নিয়ে কবি লিখেছেন —
ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে/
জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে
/ঘন-গৌরবে নব যৌবনা বরষা
/শ্যাম-গম্ভীর সরসা।
বর্ষায় গ্রাম বাংলার নদী-নালা, খাল-বিল,পুকুর-ডোবা,নিম্ন-ভূমি সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায় বলে নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। গ্রামের মানুষকে এ সময় নৌকা, ডিঙি প্রভৃতিতে চড়ে চলাফেরা করতে হয়।তাই তো প্রাচীনযুগের বাঙালি কবি ভুসুকুপা,তাঁর পদে বাংলার বিভিন্ন চিত্র উজ্জ্বলভাবে ফুঁটে উঠেছে।তাঁর ৪৯ চর্যাটির চারখানা চরণ হল-(আধুনিক বাংলায়ঃ) “ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল”।
চর্যায় রহস্যময় চরিত্রগুলোর মধ্যে ডোম্বীপা উল্লেখযোগ্য।তার সময়কাল মোটামুটি ৭৯০ থেকে ৮৯০ খৃস্টাব্দের মধ্যে।চর্যায় তাঁর গানটি মূলত ধনসী রাগে রচনা করেছিলেন তিনি। এখানে গঙ্গা ও যমুনা নদীর দৃশ্য,বর্ষার সাঁঝের কথা, কড়ি ছাড়াই মাঝিদের নৌকা পার করে দেওয়ার কথা রয়েছে। তার ১৪ নং পদটির আধুনিক বাংলায়
সংক্ষেপঃ
“গঙ্গা যমুনা মাঝে রে বয় নৌকা,
তাউ চড়িয়া চণ্ডালী ডোবা লোককে অনায়াসে পার করে ।।
বা তুই ডুমনি ! বা লো ডুমনি ! পথে হইল সাঁঝ,
সদ্গুণ পায়ের প্রসাদে যাইব পুনরায় জিনপুর ।।……
(ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচীর তিব্বতী তর্জমার আলোকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মূল পদ সংশোধিত অংশ।)
প্রাচীনযুগের কাব্যে বর্ষাকে নিয়ে প্রত্যক্ষভাবে কোনো পদাবলী রচিত না হলেও মধ্যযুগীয় পদাবলী সাহিত্যে বর্ষার পদগুলো যদি আমরা দেখি- সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস,জ্ঞানদাস,গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।মিথিলার কবি বিদ্যাপতির বর্ষা বিরহের শ্রেষ্ঠ পদটি এখানে তুলে ধরছি,তিনি লিখেছেন-
“এ সখি হামারি দুঃখের নাহি ওরএ ভরা বাদর মাহ ভাদরশূন্য মন্দির মোর।”
‘মত্ত দাদুরি ডাকিছে ঘঘনে
ফাটি যাওত ছাতিয়া।…’
সখি আমার দুঃখের কোনো শেষ নেই। এ ভরা বাদল, ভাদ্র মাস। আমার মন্দির শূন্য। চারদিকে মেঘ গর্জন করছে, ভুবন ভরে বর্ষণ হচ্ছে, শত শত বজ্র পতিত হচ্ছে, ব্যাঙ এবং ডাহুক ডাকছে।
চণ্ডীদাস যেমন লিখেছিলেন-
‘এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা, কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে, দেখিয়া পরাণ ফাটে’।…
বাঙালির জীবনমান কৃষি নির্ভর,বর্ষা কৃষিক্ষেত্রে অপরিসীম প্রভাব ফেলে।
খনার বচনে বর্ষার বিভিন্ন দিকের কথা আমরা দেখতে পাই।
এই যেমন ” শ্রাবণের পুরো ভাদ্রের বার; এর মধ্যে যত পার ” অর্থাৎ খনা বলছেন, সারা শ্রাবন মাস ধরে ধান রোপন করা গেলেও ভাদ্রের যাবে ১২ তারিখ পর্যন্ত। আবার কৃষিকাজের ক্ষেত্রে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা জরুরি একটা বিষয়। সেটা নিয়েও খনার বচন রয়েছেঃ” চৈত্রেতে খর খর; বৈশাখেতে ঝড় পাথর। জ্যৈষ্ঠতে তার ফুটে; তবে জানবে বর্ষা বটে। “
মধ্যযুগে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে কাব্যচর্চা হলেও আধুনিকযুগের কবি, সাহিত্যিকগণ তাঁদের রচনায় মানুষের জীবন জীবিকার সাথে তাল মেলাতে বর্ষা এসেছে নানা আঙ্গিকে।আধুনিকযুগের অন্যতম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় লিখেছেন–
গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর,
উথলিল নদনদী ধরণী উপর ।
রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,
দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে।
সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব,
বরুণ প্রবল দেখি প্রবল প্রভাব ।
স্বাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়,
কলহ করয়ে কোন মতে শান্ত নয়।।
বর্ষার প্রবল বর্ষণে বান ডেকে আনে, রাস্তাঘাট জলে ডুবে একাকার।যেদিকে তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি।তাই তো মরমি কবি ফকির লালন গাইলেন বিরহের গান–
গেরাম বেয়ে অগাধ পানি কেমনে যাব পরশির বাড়ি/ও সে পরশি যাদি আমার হতো/মন যাতনা সবই যেত দূরে।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও গানে বর্ষাকে রূপায়িত করেছেন নানারূপে।
বর্ষা যেন পূর্নতা পেয়েছে তাঁর কলমের আঁচড়ে।তাঁর’আষাঢ়’সোনার তরী’বাঁশি’কবিতা সহ অনেক গানেও বর্ষা এসেছে ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য নিয়ে।
রবীঠাকুরের একটি গানের কথাই বেশি মনে পড়ছে–পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে/পাগল আমার মন জেগে উঠে।‘সোনার তরী’ কবিতায় গভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে এভাবে–
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা/ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা/
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষাকে দেখেছেন গভীর অনুভূতি দিয়ে।কখনো প্রেমের উত্তাপ কখনো বিরহ-বিষাদের যন্ত্রণায় কাতর।তাঁর’বর্ষা বিদায়’কবিতায় তা অনুধাবন করা যায়–
ওগো বাদলের পরী।/ যাবে কোন দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী।/ ওগো ও ক্ষণিকা, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজি তব?/ পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?
এছাড়াও কবি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, আসাদ চৌধুরী, হাসান হাফিজ প্রমুখ কবিরা তাঁদের লেখা গল্প,কবিতা উপন্যাসে নানা আঙ্গিকে বর্ষাকে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী এবং জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে।
প্রাচীন ভারতীয় কবি কালিদাসের কালজয়ী বর্ষাকাব্য “মেঘদূত” সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও বুদ্ধদেব বসু,শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ সাহিত্যিকগণ সাবলীল বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
গ্রীষ্মের প্রখর খরার পর বর্ষা যেমন প্রকৃতিকে করে সজীব প্রাণবন্ত, মানুষের মনে জাগায় প্রশান্তি তেমনি অতি বৃষ্টি,জলোচ্ছ্বাসের ফলে মানুষের জীবনে ঘটে নৈতিক, সামাজিক ভোগান্তি।আর তাই সামাজিক জীবনের সুখ-দুঃখ নিয়ে রচিত হচ্ছে গল্প,কবিতা,উপন্যাস, গান যা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে।