মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫৬ অপরাহ্ন
নওগাঁ জেলা প্রতিনিধিঃ
নওগাঁর মহাদেবপুরে পরকীয়ার অপবাদ দেয়ার জের ধরে শ্রীমতি বন্দনা রাণী (২২) নামে এক গৃহবধূ গ্যাসবড়ি সেবনে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যারা গুজব ছড়িয়ে তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টরা কোনই ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেননি। বিষয়টি এখন মহাদেবপুরের ট্যক অব দ্য টাউনে পরিণত হলেও সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য হওয়ায় ভয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস দেখাচ্ছেন না কেউ।
উপজেলার চাঁন্দাশ ইউনিয়নের দক্ষিণ চাঁন্দাশ গ্রামের মৃত ধীরেন চন্দ্র বর্ম্মণের ছেলে মাধব চন্দ্র বর্ম্মণের স্ত্রী বন্দনা রাণী গত ৩১ মার্চ রাত ১০টার দিকে সকলের অগোচরে গ্যাস বড়ি সেবন করেন। পরে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতড়াতে থাকলে পরিবারের সদস্যরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন। কিন্তু আসার পথেই তার মৃত্যু হয়। এব্যাপারে মহাদেবপুর থানায় একটি ইউডি মামলা রেকর্ড করে পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ সৎকারের নির্দেশ দেয়া হয়। মহাদেবপুর থানার এসআই আব্দুল মতিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এরপরই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে যে, স্থানীয়দের অপবাদের মুখে পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনে টিকতে না পেরে বন্দনা রাণী আত্মহত্যা করলেও অভিযুক্তদের ব্যাপারে পুলিশ কোনই পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আত্মীয় স্বজন জড়িয়ে বন্দনা রাণীর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে উপস্থিত বন্দনার স্বামী মাধব চন্দ্রের দুলাভাই ভীমপুর গ্রামের মহাদেব চন্দ্র ও সুনীলের সাথে কথা বললে তারা জানান, ৮ কাঠা জমি বন্ধক রেখে টাকা সংগ্রহ করে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পার করছেন। এজন্য স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ কোন সহযোগিতা করেননি। তারা বন্দনার আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে নানা কথা বলেন। ওই গ্রামেই বন্দনার শ্বশুড়বাড়ি ।েথকে কয়েকশ’ মিটার দূরে বন্দনার বিশাল দাদাবাড়ি। সেখানে কথা হয় বন্দনার জেঠা সুরেশ চন্দ্র বর্ম্মণ, তার ছেলে শুভ ও অন্যান্যদের সাথে। এছাড়া কথা হয় গ্রামের লোকদের সাথে। সকলের একান্ত আলাপচারিতায় ওঠে আসে বন্দনা রাণীর আত্মাহুতির গল্প।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, গত ৭ মার্চ দিবগত রাত ৮টার দিকে চাঁন্দাশ ইউপি মেম্বার খাইরুল ইসলাম ও তার সঙ্গী বেলাল হোসেন বন্দনার বাড়িতে ঢোকেন। এসময় বন্দনা রাণী ও তার ৫ বছরের ছেলে নিলাভ ছাড়া অন্য কেউ বাড়িতে ছিলনা। বন্দনার স্বামী উপজেলা সদরের একটি দোকানে কাজ করেন জন্য বাড়ি আসতে একটু রাত হয়। বিষয়টি জানতে পেরে স্থানীয়রা বাড়ির গেটের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরে তারা অসামাজিক কাজের অভিযোগ তুলে খাইরুল মেম্বার ও বেলাল হোসেনকে আটক করে রাখে। খবর পেয়ে সাবেক মেম্বার বাবুল হোসেন লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিষয়টি মিমাংশা করেন। ১২ মার্চ এব্যাপারে একটি ফেসবুক আইডি থেকে খাইরুল মেম্বার ও বেলাল হোসেনের ছবি লাল কালি দিয়ে মেনশন করে তাদের পরকীয়ার বিষয়ে ভর্ৎসনা করে একটি পোস্ট দেয়া হয়। এনিয়ে বন্দনার পরিবার চরম মানষিক লাঞ্ছনার শিকার হন। বন্দনার স্বামী মাধব চন্দ্র বর্ম্মণ জানান, ঘটনার পর থেকে বন্দনা রাণী মুষরে পড়েন। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি বাড়ি থেকে বের হতেন না। বাড়ির কোন কাজও ঠিকমত করতেন না। স্থানীয়রা জানান, বন্দনার পরিবার থেকেও তাকে গালিগালাজ ও নির্যাতন করা হতো। বন্দনার দাদা বাড়ি পাশেই হলেও সেখানে যাবার মত পরিবেশ ছিলনা। কারণ তার বাবা ক্ষেত্রনাথ বর্ম্মণ ও ভাই দিপু অনেক আগেই ভারতবাসী হয়েছেন। তার বাবার অংশের সোয়া এক বিঘা জমি বন্দনা পাবেন। কিন্তু তা ভোগ দখল করছিলেন বন্দনার জেঠা সুরেশ চন্দ্র বর্ম্মণ। তাই তার জেঠার বাড়িতে যেতেন না তিনি। এসব নানা কারণে জীবনের প্রতি চরম বিতৃষ্ণায় বন্দনা রাণী গ্যাস বড়ি সেবন করেন।
জানতে চাইলে খাইরুল মেম্বার জানান, তিনি বন্দনার বাড়ির পাশে একটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেন। পুকুরে গিয়ে তিনি বন্দনার বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখছিলেন। বেলাল হোসেনও টিভি দেখতে গিয়েছিলেন বলে জানান। কিন্তু গ্রামের লোকজন তাদের সাথে পরকীয়ার অভিযোগ তুলে তাদেরকে আটক করে। সাবেক মেম্বার বাবুল হোসেনও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, বিষয়টি সেদিনই মিমাংশা করা হয়েছে। বন্দনার জেঠা সুরশ বর্ম্মণ জানান, গ্রামের লোকজন ও সমাজ যেটা করে দিয়েছে তারা সেটা মেনে নিয়েছেন। তবে সকলেই স্বীকার করেন যে, ওই ঘটনার জের ধরেই বন্দনা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। বন্দনা রাণী নিহতের ঘটনায় দায়ের করা অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা এসআই আব্দুল মতিন এসব ঘটনা জানেন না বলে জানান। মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এর দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর (তদন্ত) নাজমুল হুদা জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।