রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:২৩ অপরাহ্ন
মো. সেলিম উদ্দিন খাঁন
কক্সবাজার ও বান্দরবানে মৌসুমের শুরুতেই ১১ উপজেলায় প্রস্তুত ৯৭ অবৈধ ইটভাটা। ১১ উপজেলায় ইটভাটা আছে ১৩১টি। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র কিংবা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই ৯৭টির। অবৈধ এসব ভাটায় বছরের পর বছর ধরে বনের কাঠ পুড়িয়ে চলছে শতকোটি টাকার ইট-বাণিজ্য। ফসলি জমির টপসয়েল ও পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে চলছে ইট তৈরি। একদিকে বনাঞ্চল উজাড়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে ভাটার কালো ধোঁয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ অবৈধ ইটভাটার মালিক আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থক হলেও গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর ইটভাটাগুলোর পরিচালনা করছে অন্য রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা। এখন অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে গেলেই পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে হামলা, যানবাহন ভাঙচুর ও ট্রাক রেখে রাস্তা অবরোধ করার মতো ঘটনা ঘটছে। জেলা প্রশাসন, বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজারের ৯ উপজেলায় ২০২২ সালে ইটভাটা ছিল ১০৪টি। ২০২৩ সালে অভিযান চালিয়ে ২০টি ইটভাটা উচ্ছেদ ও ৩৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে পরিবেশ অধিদপ্তর। বর্তমানে কক্সবাজারের ৯ উপজেলায় ইটভাটা আছে ৮৪টি। এর মধ্যে ৫৪টিতে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই। যার মধ্যে ৩১টি ইটভাটা তৈরি হয়েছে বনাঞ্চলের আশপাশ ও ভেতরে। অবৈধ বাকি ইটভাটাগুলো বান্দরবানের লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ির সংরক্ষিত বনের পাশে নির্মিত হয়েছে। ভাটাগুলোয় দৈনিক অন্তত ৭ লাখ ইট উৎপাদন হচ্ছে বলে জানা গেছে। একটা সময় অবৈধ ইটভাটাগুলো পরিচালনা করতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পটপরিবর্তনের পর রাতারাতি ইটভাটাগুলোর মালিক বনে গেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা। অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযানে গেলে রাজনৈতিক দলের নেতারা লোকজন নিয়ে অভিযানকারী দলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক মো. জমির উদ্দিন দ্য ডেইলি রুপবাণীকে বলেন, একটা সময় অবৈধ ইটভাটাগুলো পরিচালনা করতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পটপরিবর্তনের পর রাতারাতি ইটভাটাগুলোর মালিক বনে গেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা। অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযানে গেলে রাজনৈতিক দলের নেতারা লোকজন নিয়ে অভিযানকারী দলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর করে অভিযান ভন্ডুল করে দিচ্ছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তরের এই অভিযান চলমান রাখা হবে। মো. জমির উদ্দিন বলেন, চকরিয়া ও লামার মধ্যবর্তী ফাইতং মৌজার একটুকরো বনাঞ্চলে কয়েক বছর আগে তৈরি হয়েছে ৩৮টি ইটভাটা। কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। বনের কাঠ পুড়িয়ে এসব ভাটায় কোটি টাকার ইট তৈরি হচ্ছে। তাতে বৈধ ইটভাটার মালিকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। চকরিয়ার মানিকপুর-সুরাজপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত বনে ইটভাটা আছে ১২টি। এর মধ্যে কয়েক একর সরকারি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয় এফসি নামের একটি ইটভাটা। সম্প্রতি সেখানে দেখা গেছে, ২০-২৫ জন শ্রমিক পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে তৈরি করছেন ইট। ইট পোড়ানোর জন্য চিমনির পাশে স্তূপ করে রাখা হয় গাছের গুঁড়ি। কিছুটা দূরে লামার ফাইতং মৌজার সংরক্ষিত বনে ইটভাটা রয়েছে ৪০টি। সেখানে ৩২টি ভাটায় ইট তৈরি হচ্ছে। কয়েকটি ভাটার চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
সরকারি অভিযানে বাধা দেওয়ার ঘটনায় গত ১৭ নভেম্বর লামা থানায় মামলা করেন পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান কার্যালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ নুর উদ্দিন। মামলায় এবি পার্টির কেন্দ্রীয় পর্যটনবিষয়ক সহসম্পাদক এবি ওয়াহিদ, এনসিপির চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম সমন্বয়কারী এরফানুল হকসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ৪০০ জনকে।
কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও ও চকরিয়ায়ও কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি হচ্ছে আরও ২৭টি ভাটায়। সম্প্রতি রামুর কাউয়ারখোপ বাজারের পাশে (বনাঞ্চলের কাছাকাছি) দুটি ভাটায় গিয়ে দেখা গেছে, বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট উৎপাদন হচ্ছে। কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। একটি ইটভাটার মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছাড়পত্রের জন্য কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু বনাঞ্চলের পাশে ভাটা স্থাপন করা হয়েছে—এই অজুহাতে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিচ্ছে না। তারপরও স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য ভাটা চালু রাখতে হচ্ছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ইটভাটা আছে ৪০টি। এর মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র নেই ২৫টির। ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। আইনে বলা আছে, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষিজমিতে ইটভাটা করা যাবে না। ইট উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলা থেকে মাটি কেটে কাঁচামাল এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়। গত ১৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের জন্য যান চকরিয়ার মানিকপুরে। অভিযানে এএমবি-১, এএমবি-২ ও এএমবি-৩ নামের তিনটি ইটভাটা খননযন্ত্র দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর যৌথ বাহিনী পাশের ফাইতং মৌজার অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হলে প্রভাবশালীদের ইন্ধনে কয়েক শ শ্রমিক সড়ক অবরোধ করে বাধার সৃষ্টি করেন। দুপুর ১২টার দিকে কিছু শ্রমিক কাফনের কাপড় পরে রাস্তার ওপর শুয়ে পড়েন, শতাধিক শ্রমিক মানববন্ধন করে ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান রুখে দেওয়ার হুমকি দেন। শ্রমিকদের দাবি ছিল, অবৈধ ভাটা হলেও উচ্ছেদ করলে ২০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না করে কাউকে ইটভাটা উচ্ছেদ করতে দেওয়া হবে না। এমন পরিস্থিতি অভিযান স্থগিত করে ফিরে আসেন যৌথ বাহিনী। সরকারি অভিযানে বাধা দেওয়ার ঘটনায় ১৭ নভেম্বর লামা থানায় মামলা করেন পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবান কার্যালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ নুর উদ্দিন। মামলায় এবি পার্টির কেন্দ্রীয় পর্যটনবিষয়ক সহসম্পাদক এবি ওয়াহিদ, এনসিপির চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম সমন্বয়কারী এরফানুল হকসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ৪০০ জনকে।
হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ২০ নভেম্বর চকরিয়া থানায় আরেকটি মামলা করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম। মামলায় চকরিয়া পৌরসভার সবুজবাগ এলাকার দিদারুল আলমসহ পাঁচ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৬০০ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু দুই মামলার কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, চকরিয়ার অবৈধ তিনটি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ফাইতং এলাকার কয়েকটি অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে গেলে মালিক-শ্রমিকেরা হামলা চালিয়ে যৌথ বাহিনীর উচ্ছেদ অভিযানে বাধার সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। মামলা আসামি হওয়া প্রসঙ্গে জানার জন্য একাধিকার যোগাযোগ করেও এনসিপি ও এবি পার্টির দুই নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দুজনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।