শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৫ পূর্বাহ্ন
অনেক সিয়াম পালনকারী দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে সিয়ামের ক্ষেত্রে অনেক ভুল করে থাকে। তারা জানে না, কীসে সিয়াম নষ্ট হয় আর কীসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনুরূপ তারা এটাও জানে না যে, সিয়াম পালনকালে কোনটা তার জন্য সুন্নাত, কোনটা জায়েয, কোনটা ওয়াজিব, আর কোনটা হারাম?
অথচ মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত, তিনি বলেন—
“আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে তিনি দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।” [সহীহ বুখারী :১৭; সহীহ মুসলিম:১০৩৭]
হাদীসের ভাষ্যমতে প্রতীয়মান হয়, যে-ব্যক্তি দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে না কিংবা ধর্মীয় বিষয়াবলি কারও কাছ থেকে জেনে নেয় না, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনাে কল্যাণ বরাদ্দ নেই।
অধিকন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তার বান্দাদের জ্ঞান আহরণের নির্দেশ দিয়ে বলেন—
“যদি তােমরা না জানাে, তবে জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও।” [সূরা নাহল, আয়াত : ৪৩]
উল্লেখ্য যে, উপযুক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘আহলুয যিকির’ বলে আলেমদের বােঝানাে হয়েছে। সুতরাং, যে মুসলিম যথাযথভাবে আল্লাহর ইবাদাত করতে চায়, তার জন্য জরুরী হলাে, দ্বীনের যে-সকল বিষয় তার অজানা, সে-সম্পর্কে জেনে নেওয়া, ধর্মীয় বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জন করা এবং অজ্ঞতাগুলাে দূর করা।
রামাদানে অনেক সিয়াম পালনকারী এমন পাপকর্মে লিপ্ত হয়, যা তাদের সিয়াম-কিয়াম বরবাদ করে দেয়। যেমন—গীবত, পরনিন্দা, চোগলখুরি, অশ্লীল কথা-বার্তা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অন্যায় অভিশাপ ইত্যাদি।‘জিহ্বার সিয়াম‘ অংশে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে।
রামাদানে সবচেয়ে মারাত্মক যে-ভুলটি কমবেশি সবাই করে থাকে সেটা হচ্ছে খাবারের অপচয়। কারণ, সাহরী ও ইফতারে প্রায় ঘরেই দুই-চারজন মানুষের জন্য পাঁচ-দশ পদের খাবারের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। এতে ফল যা হবার তাই হয়। কিছু অংশ খাওয়ার পর বাকি অংশ ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। অথচ তারা চাইলে এই খাবার দিয়েই ছােটবড় একাধিক পরিবারের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারত এবং তাদের জন্য তৃপ্তিদায়ক সাহরী ও ইফতারের ব্যবস্থা করতে পারত। মহান আল্লাহ অপচয়কে ইসলামের নীতি-বিরুদ্ধ ঘােষণা করে বলেছেন—
“আর তােমরা খাও এবং পান করাে; কিন্তু অপচয় কোরাে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আরাফ, আয়াত : ৩১]
উপযুক্ত আয়াত থেকে স্পষ্টতই বােঝা যাচ্ছে যে, মানুষের মৌলিক চাহিদা ও প্রয়ােজনের অতিরিক্ত ব্যয় করা ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এজাতীয় অপচয়ে মহান আল্লাহ ভীষণ রুষ্ট হন এবং অপচয়কারীকে হতভাগ্য শয়তানের অনুচর হিসেবে পরিগণিত করেন। কুরআনের ভাষায়—
“তােমরা অপচয় কোরাে না। কারণ, অপচয়কারীগণ শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।” [সূরা ইসরা, আয়াত : ২৬২৭]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন—
“আর যখন তারা ব্যয় করে তখন অপচয় যেমন করে না তেমনই কৃপণতাও করে না; বরং তাদের ব্যয় হয় এতদুভয়ের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ।” [সূরা ফুরকান, আয়াত : ৬৭]
রামাদান মাস এলেই দেখা যায়, হাট-বাজার ক্রেতায় ভরে যায়। প্রত্যেকেই এত বেশি খাদ্য-পানীয় ক্রয় করে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় দশটি-দশটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট। অথচ তাদের প্রতিবেশী কত পরিবার ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাচ্ছে। এক টুকরাে বাসি রুটি দিয়ে সাহরী-ইফতার সেরে নিচ্ছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ফুটপাতে শুয়ে পড়ছে।
সিয়ামের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলাে, কম খাওয়ার মাধ্যমে পাকস্থলীর দৃষিত পদার্থসমূহ বের করে দেওয়া। যারা খাদ্য-পানীয়-এর ক্ষেত্রে এত বেশি অপচয় করে এবং প্রয়ােজন বা সাধ্যের অতিরিক্ত খাওয়ার চেষ্টা করে তাদের কি আদৌ এ উদ্দেশ্য অর্জিত হবে?
এমন সিয়াম পালনকারীর সংখ্যাও কম নয়, যারা সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। তাদের দেখে মনে হয়, তারা যেন সিয়ামই রাখেনি। অনেকে তাে শুধু সালাতের সময় জাগে। সালাত পড়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবে ঘুম ও অবহেলায় সারা দিন পার করে দেয়। আর সারা রাত আমােদ-প্রমােদে মেতে থাকে।
অধিকন্তু সিয়ামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হিকমত ও উদ্দেশ্য হলাে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ক্ষুধা-তৃয়ার স্বাদ আস্বাদন করা। যারা সারাটা দিন ঘুমের ঘােরে কাটিয়ে দেয়, তারা কি সেই আস্বাদ অনুভব করতে পারে?
অনেক সিয়াম পালনকারী আবার সারা দিন মাকরুহ বা হারাম খেলা-ধুলায় মত্ত থাকে। যেমন—দাবা, পাশা, তাস, ফুটবল—ইত্যাদি। তারা এসব খেলাকে আত্মপ্রশান্তির কারণ ও আনন্দময় অবকাশ যাপনের মাধ্যম মনে করে। তাদের এই ক্রিয়া-কর্মের ব্যাপারে সতর্ক করে মহান আল্লাহ বলেন—
“তােমরা কি মনে করাে যে, আমি তােমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি, আর তােমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?” [সূরা মুমিনুন, আয়াত : ১১৫]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন—
“আপনি তাদের কথা ছেড়ে দিন, যারা তাদের দ্বীনকে খেল-তামাশার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং যাদের পার্থিব জীবন প্রবঞ্চিত করেছে।” [সূরা আনআম, আয়াত : ৭০]
অনেক সিয়াম পালনকারী অযথা রাত্রি-জাগরণ করে। অনর্থক খেল-তামাশায় সময় নষ্ট করে। শপিংমল, রাস্তা-ঘাট ও পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়; কিন্তু দুই মিনিট সময় ব্যয় করে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে না। অনেকে তাে আবার এরচেয়েও মারাত্মক ভুল বা অপরাধে লিপ্ত হয়। সামান্য ও তুচ্ছ কারণে জামাআতে সালাত আদায় করা থেকে পিছিয়ে থাকে। অথচ তারা নিজেরাও হয়তাে জানে, এটা স্পষ্ট মুনাফিকের আলামত এবং অন্তরের ব্যাধির আলামত ও আত্মার অপমৃত্যুর প্রমাণ।
এমন সিয়াম পালনকারীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়, রামাদানে কুরআনে কারীমের সঙ্গে যাদের দূরতম সম্পর্কও থাকে না। জাগতিক অনেক কিছুই হয়তাে পড়ে; কিন্তু একটিবারের জন্যও কুরআন খুলে দেখার সময় পায় না। অনেকে আবার এমনও আছে, এই দয়া ও উদারতার মাসেও যাদের হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হয় না। ভেতরে সাদাকার প্রেরণা জাগে না। এ কারণে তাদের দস্তরখানে অন্য সিয়াম পালনকারীর সাহরী বা ইফতারের আয়ােজন লক্ষ করা যায় না; বরং অভাবীদের জন্য তাদের গৃহ ও হৃদয়ের দুআর সব সময় বন্ধ থাকে। তাদের এই মানসিকতার নিন্দা করে মহান আল্লাহ বলেন—
“তােমাদের কাছে যা আছে, তা শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু আমার কাছে যা আছে তা চিরদিন বাকি থাকবে।” [সূরা নাহল, আয়াত : ৯৬]
তিনি আরও বলেন—
“তােমরা নিজেদের জন্য কল্যাণকর যা-কিছু অগ্রে প্রেরণ করবে, তা তােমরা আল্লাহর কাছে পাবে।” [সূরা বাকারা, আয়াত : ১১০]
অনেক সিয়াম পালনকারী অলসতা করে তারাবীহ সালাত ছেড়ে দেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা যেন বলতে চায়, ‘ফরয আদায় করাই তাে যথেষ্ট’। অথচ দ্বীনের ক্ষেত্রে এই অল্পেতুষ্ট লােকগুলােই দুনিয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু মােটেও অল্পে তুষ্ট হয় না; বরং সব সময় উন্নতি ও সমৃদ্ধির চিন্তায় বিভাের থাকে।
অনেক সিয়াম পালনকারী ত্ৰী বা পরিবারের অন্যান্য নারীদের বিভিন্ন ধরনের খাবার-পানীয় প্রস্তুত করার আদেশ দিয়ে এতটাই ব্যতিব্যস্ত রাখে যে, আগ্রহ থাকলেও তারা কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর যিকির এবং অন্যান্য নফল ইবাদাত পালনের অবসরই পায় না। অথচ পরিবারের কর্তাব্যক্তিগণ যদি সাহরী ও ইফতারের জন্য একান্ত প্রয়ােজনীয় খাবার তৈরিই যথেষ্ট মনে করত, তাহলে পরিবারের নারী সদস্যরা আল্লাহর ইবাদাত ও দুআ-মুনাজাতের মাধ্যমে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহের সুযােগ পেত।
হে আল্লাহ, তুমি আমাদের নিয়ামত বাড়িয়ে দাও; কমিয়ে দিয়াে না। আমাদের দান করাে, বঞ্চিত কোরাে না। আমাদের সম্মানিত করাে, অপমানিত কোরাে না। আমাদের প্রতি দয়া করাে। নির্দয় হয়াে না। আমাদের ক্ষমা করাে। শান্তি দিয়াে না।
উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৮২ – ৮৬