মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:৩০ পূর্বাহ্ন
মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন বিশেষ প্রতিনিধি:
কক্সবাজারের চকরিয়ায় সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই লোকালয়ে গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি অটো ব্রিকস তৈরির কারখানা। অভিযোগ ওঠেছে, সরকারি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইন্সেস, পরিবেশ অধিদপ্তর কতৃক ছাড়পত্র ও পৌরসভার ট্রেড লাইন্সেস কোনোটাই নেই ইট তৈরির কারখানাগুলোতে। দুটি কারখানায় শুধু ফায়ার সার্ভিসের সনদ থাকলেও অপর একটিতে সেটিও নেই। তারপরও নিজস্ব দাপটে গেল ৬-৭ মাস ধরে এসব কারখানায় ইট তৈরি এবং বাণিজ্য শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারখানাগুলোতে ইট তৈরির সময় বিকট শব্দের কারণে আশপাশের বাসিন্দারা ইতোমধ্যে শব্দদূষণ যন্ত্রনায় পড়ে নানাধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।এ অবস্থায় ভুক্তভোগী বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টার কাছে ইট তৈরির কারখানা বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন অভিযুক্ত বাটাখালী সেতু এলাকার এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার নামের ইট তৈরির কারখানাটি বন্ধ করে দিতে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এরই প্রেক্ষিতে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে অবৈধ ইট তৈরির কারখানা সিলগালা করে দিলেও অভিযুক্ত কারখানা মালিক রাতের আঁধারে ফের ইট তৈরির কারবার শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। সরকারি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই এভাবে চলছে চকরিয়া পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের তরছপাড়া এলাকার মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রি, বাটাখালী সেতু এলাকার এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার ও চোঁয়ারফাঁড়ি এলাকার মা-বাবার দোয়া ব্লক ফ্যাক্টরি নামের তিনটি কারখানা।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত ছাড়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে কারখানাগুলো চলছে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে ভোররাতে উপজেলার চোঁয়ারফাঁড়ির মা-বাবার দোয়া ব্লক ফ্যাক্টরির অফিসকক্ষে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে কারখানাটির অফিসকক্ষ পুড়ে গেছে।
এরআগে গত ১৮ ডিসেম্বরের দিকে মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস কারখানায় ইট ব্লক তৈরির মিক্সচার মেশিন পরিষ্কার করার সময় বৈদ্যুতিক লাইন চালু হয়ে মেশিনের সঙ্গে পিষ্ট হয়ে দুই শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত দুজন শ্রমিকের নাম চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ ঘুনিয়া গ্রামের মো. শাহজাহানের ছেলে শাহাদাত হোসেন শহীন (১৭) ও চকরিয়া পৌরসভার করাইয়াঘোনা এলাকার রুহুল কাদেরের ছেলে কামরানুল ইসলাম জিহান (১৮)।
সূত্রে জানা যায়, কোনো কারখানা স্থাপনের আগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন ও লাইন্সেস করতে হয়। কারখানাটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোন সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত ও কতজন শ্রমিক কাজ করছেন তা উল্লেখ করতে হয়। লাইন্সেস ছাড়া তিনটি কারখানায় উৎপাদন শুরু করেছে।
এসব কারখানার সরকারি কোনো দপ্তরের ছাড়পত্রও নেই।দুইমাস আগে গত ৩১ অক্টোবর পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার পরিদর্শন করে শব্দ দূষণের সত্যতা পেয়ে কারখানাটি বন্ধের জন্য কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমির উদ্দিন একটি প্রতিবেদন দেন। চকরিয়া পৌরসভার সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কারখানা স্থাপনের জন্য পৌরসভা থেকে অনাপত্তি সনদ পাওয়ার পর ট্রেড লাইন্সেস প্রদান করা হয়।
অনাপত্তি সনদ পেতে কারখানা স্থাপন ও পরিচালনার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধি অনুসরণ, পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত পদ্ধতিতে ছাড়পত্র, কর্মরত শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত, অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা, অগ্নিকাণ্ড কিংবা দুর্ঘটনার জরুরি নির্বাপন, বায়ু ও শব্দ দূষণ করা যাবে না-এমন কিছু শর্তাবলি রয়েছে। সরেজমিনে জানা গেছে, মাতামুহুরি নদীর পাশে চকরিয়া পৌরসভার তরছপাড়া মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান।
সেখানে চার ধরনের লোগো ব্রিকস, সলিড ব্রিকস ও ইউনি পেভার ইট ও ব্লক তৈরি হয়। কারখানার ভেতর ও বাহিরে লাখের অধিক ইট ও ব্লক তৈরি করে রাখা হয়েছে। দুজন শ্রমিক নিহত হওয়ার পর থেকে কারখানাটি বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয় তরছপাড়ার জয়নাল আবেদীন ও নাজেম উদ্দিন বলেন, ‘কারখানার শব্দ দূষণ ও ধূলাবালির কারণে এলাকায় বসবাস করা যাচ্ছে না। আমরা প্রশাসনের কাছে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছি। কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শুনেছি, দুজন শ্রমিক নিহত হওয়ার পর তাদের পরিবারকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছে কারখানার মালিকপক্ষ।’
জানতে চাইলে মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার জামাল হোসেন বলেন, ‘কারখানায় প্রতিষ্ঠানে কোনো কাগজপত্র নেই। পৌরশহরে কারখানা মালিকের অফিসে রয়েছে, তার সঙ্গে দেখা করলে বিস্তারিত জানবেন।’
মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির মালিক ইঞ্জিনিয়ার কফিল উদ্দিন সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘কারখানা খুলতে আমরা কোম্পানি খুলেছি। যে দুজন শ্রমিক মারা গেছে, তারা আল্লাহের হুকুমে মারা গেছে। আমাদের কাছে কাছে সব ধরনের কাগজপত্র আছে।’ তবে তার কাছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইন্সেস, ট্রেড লাইন্সেসের কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি।
চকরিয়া পৌরসভার লাইন্সেস পরিদর্শক কামাল হোছাইন বলেন, ‘মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির নামে ট্রেড লাইন্সেসের জন্য আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির একজন ব্যক্তি। কিন্তু কারখানা স্থাপনের জন্য যেসব কাগজপত্র ও শর্তাবলি রয়েছে, তা না থাকায় আমরা তাকে ট্রেড লাইন্সেস দিইনি। যদি এসব শর্ত পূরণ করে লাইন্সেস প্রদান করা হবে।’
চকরিয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘গত সোমবার ভোররাত সাড়ে তিনটার দিকে মা-বাবার দোয়া ব্লক ফ্যাক্টরির অফিসকক্ষে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে প্রতিষ্ঠানটির অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা থাকায় তেমন ক্ষতি হয়নি। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত্র হয়েছে।’
জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ‘চকরিয়ার কোনো অটো ব্রিকসকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার পরিদর্শন করে শব্দ দূষণের সত্যতা পাওয়ায় প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা গেছে, দুই মাস আগে গত ৩১ অক্টোবর অভিযুক্ত এলএইচবি ব্লক বিকস্ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমির উদ্দিন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক বরাবরে সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক অবহিত পত্র পাঠিয়েছেন।
কিন্তু অভিযোগ ওঠেছে, বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী উপপরিচালক শ্রীরূপ মজুমদার অদ্যবদি কোনোধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।
অবশ্য মুঠোফোনে জানতে চাইলে শ্রীরূপ মজুমদার বলেন, ইতোমধ্যে অভিযুক্ত এলএইচবি ব্লক বিকস্ সেন্টারের মালিককে প্রতিষ্ঠানের স্বপক্ষে বৈধ কী কী কাগজপত্র আছে তা নিয়ে হাজির হতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘উপজেলায় তিনটি অটো ব্রিকস কারখানা রয়েছে। অনুমোদন ছাড়া এসব কারখানায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালিয়ে একসঙ্গে উচ্ছেদ করা হবে।’