রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০১ পূর্বাহ্ন
মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন বিশেষ প্রতিনিধি:
‘মাঘের শীত বাঘের গায়ে, শীতের জ্বালায় বাঘ কাঁপে’ আমাদের দেশের গ্রামবাংলার একটি প্রচলিত প্রবাদ। শক্তিশালী ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ প্রাণীটি মাঘের শীতের প্রভাব থেকে রেহায়ই পায় না। তীব্র শীতে বাঘও কাবু হয়।
শীতের কথা স্মরণ করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা চারপাশ। হিমেল বাতাসে কাঁপতে থাকা শীতার্ত মানুষ। সারি সারি খেজুরগাছে ঝুলতে থাকা রসের ভাড়। সকাল সন্ধ্যা যেথায় ভোমর অলি নৃত্য করে। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর নয়নাভিরাম দৃশ্য। এটা শীত ঋতুর একটা সাধারণ চিত্র। এছাড়া এর রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব। শীত বাঙালির প্রিয় ঋতুর একটি। শীতকাল অন্যসব ঋতু থেকে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের অনেকখানি জায়গা জুড়ে শীতের অবস্থান। শীতের সকালের রূপ অন্যসব ঋতু থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। হেমন্তের দিনগুলো শেষ হতে না হতেই শীতবুড়ি প্রকৃতিতে এসে হাজির হয়।
কুয়াশা কন্যারাও নির্জন বন-মাঠ আর নদীর কূলজুড়ে ছাউনি ফেলে। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফ চূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস। পৃথিবী কেমন যেন জড়সড় হয়ে যায় শীতে। সূর্যের আলোয় সবুজ মাঠগুলোকে মনে হয় কে যেন মুক্তার দানা ছড়িয়ে রেখেছে। সেই দানাগুলো থেকে রামধনুর সাত রঙের আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখলে পরান জুড়িয়ে যায়। শর্ষের ক্ষেতগুলোকে মনে হয় হলুদের সাগর যেথায় হিমেল হাওয়া ঢেউ খেলে যায় প্রতিনিয়ত। মাঠে মাঠে হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি। সবুজ প্রান্তরে হলুদের চাঁদর বিছানো। প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখ জুড়াতে জুড়ি নেই সরিষা ফুলের। এই ফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দেয় ভিন্ন মাত্রা, ঠিক কৃষকের মনে জাগায় স্বপ্ন। এছাড়া শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, লাউ, মুলা, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, শসা, মিষ্টি কুমড়ার ক্ষেতগুলো দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।
শীত মৌসুমে ফুলকাননের যেসব ফুল মানুষের মনকে মুগ্ধ করে তার মধ্যে ডালিয়া অন্যতম। লাল, চকোলেট, হলুদ, সাদা, গোলাপি, বেগুনি নানা বর্ণের ডালিয়ার পাপড়ির সৌন্দর্য আর চমৎকার বিন্যাস সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। কৃষ্ণকলি শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল। এ ফুল সাদা আর গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। শীত মৌসুমের আরেক ফুল কসমস। এ ফুল সাদা, লাল বা গোলাপি বর্ণের হয়। এছাড়া শীত মৌসুমে আরো যেসব জনপ্রিয় ফুল রয়েছে তার মধ্যে গ্যাজানিয়া, চন্দ্রমলিস্নকা, গাঁদা, অ্যাস্টার, ডেইজি, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, সূর্যমুখী, পর্টুলেকা, ক্যালেন্ডুলা, হলিহক, সুইট পি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্যাডিওলাস পিটুনিয়া অন্যতম। বারান্দা বা গ্রিলে ঝুলানো টবে লাগানোর জন্য পিটুনিয়া, ন্যাস্টারশিয়াস, অ্যাস্টার, ভারবেনা ইত্যাদি উত্তম। গ্রিলে লতিয়ে দেওয়ার জন্য নীলমণি লতা, মর্নিং গোরি, রেল লতা, সুইট পি ভালো।
এসব ফুলের রূপ সৌন্দর্য, পরশ মানুষের মনে স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়। শীত মানেই হরেক রকম ফলের সমাহার। শীতঋতুর কমলা, কুল, সফেদা, ইত্যাদি ফল মুখের স্বাদকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এ ঋতুর জনপ্রিয় ফলগুলোর একটি ডালিম। এ ফল কারও কাছে বেদানা, কারও কাছে আনার নামে পরিচিত। শীতে ফলের রাজা বলা হয় কমলাকে। বর্তমানে আমাদেও দেশের পার্বত্য অঞ্চল ও সিলেটে কমলার চাষ হয়। এ ঋতুতে আরো যেসব সুস্বাদু ও উপকারী ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে কুল, আমলকী অন্যতম। শীত এলে বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়।
বাংলার শীতকাল আর পিঠা যেন একসূত্রে গাঁথা। কৃষকের ঘওে হেমন্তে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পিঠা তৈরির কাজ। চলতে থাকে তা পুরো শীতকালজুড়ে। বেশির ভাগ পিঠাই মিষ্টিপ্রধান, কিছু পিঠা ঝাল জাতীয়। তবে যে পিঠাই তৈরি করা হোক না কেন, পিঠা তৈরির মূল উপকরণ চালের গুঁড়া। এক এক অঞ্চলে এক এক রকমের পিঠা তৈরি হয়। একই পিঠার নামও আবার অঞ্চলভেদে ভিন্ন। তবে এমন কিছু পিঠা আছে যা দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বানানো হয়, যেমন- চিতোই, পাটিসাপটা, পুলি, নকশি, তেলের পিঠা ইত্যাদি। শীতকালীন পিঠার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য পিঠাগুলো হলো- চিতই, পাকান, পাটিসাপটা, ভাপা, পুলি, ম্যারা, তেলে ভাজা, কাটা, ফুলঝুরি, নকশি, গোলাপ ফুল, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট, সিদ্ধ, পুতুল, লরি, তারাজোড়া, জামাই, ঝুরি, বিবিয়ানা, খান্দেশা, পাতা, গুলগুলা, লবঙ্গ, ক্ষীরডুবি, খাস্তা, ঝালপোয়া, মালপোয়া, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি, ঝাল, বিস্কুট, খাস্তা, গজা, রুটি, দুধ পায়েস, কুলি, দুধকুলি, জামাই কুলি, হাঁড়ি, চুটকি, রসপুলি, কাটা, মুরালি, খান্দাশ, পয়সা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম। এতো গেল শীতের প্রকৃতি ও ফুল ফসলের কথা, এখন আসি শীতের প্রভাব প্রসঙ্গে।
তীব্র শীতের ভিন্নতার কারণে গ্রাম ও শহরে এর প্রভাবেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তাই শীত কারোর জন্য হয় আশীর্বাদ আর কারোর জন্য হয় কষ্টের। শহরে যারা কংক্রিটের দালানে বসবাস করেন তাদের কাছে শীত আশীর্বাদ। দিনের বেলায় তারা গরম পোশাক-পরিচ্ছদ পরে চলাফেরা করেন আর রাতের বেলায় লেপ-কম্বল গায়ে দিয়ে পরম সুখে ঘুমিয়ে থাকেন।
পক্ষান্তরে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের জন্য শীতকাল বড় কষ্টের বার্তা নিয়ে আসে। বেড়া, ইট কিংবা জানালা-দুয়ারের ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে শোবার ঘরে। তখন সব বয়সী মানুষেরা তীব্র শীতে কাঁপতে থাকে। শীতের তীব্রতা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তাদের থাকে না। অসহায় ও হতদরিদ্রের কষ্ট দিন দিন বাড়তেই থাকে। যারা খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাত, বাস ও রেলস্টেশনে কিংবা নদীর পাড় ও রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে বসবাস করে তাদের কষ্টের সীমা থাকে না। তারা ছেঁড়া কাঁথা, কম্বল ও পাটের বস্তা দিয়ে শরীর আবৃত করে শীত নিবারণের চেষ্টা করে। তারা অতি সহজেই ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি, কাশির মতো শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সূর্যের কিরণই যেন তাদের শীত থেকে বাঁচার প্রধান উপায়। অনেকে খড়-বিচালি, ডালপালা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে। এ সময় দেখা যায় সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে যায় শীতার্ত অসহায় গরিব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশাগুলো ভাগাভাগি করে নিতে
শুধু মানুষই নয় গৃহপালিত ও বনের পশুপাখিরাও তীব্র শীতে কাতর থাকে। শীত ঋতুর প্রভাবে প্রকৃতি ও প্রাণিকূলের মাঝে কিছু ক্ষতিসাধন হলেও এ ঋতু আমাদের কৃষিকে সমৃদ্ধ করে। তাই বলা যায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শীতঋতুর গুরুত্ব অপরিসীম।চিতই, পাকান, পাটিসাপটা, ভাপা, পুলি, ম্যারা, তেলে ভাজা, কাটা, ফুলঝুরি, নকশি, গোলাপ ফুল, দুধ পিঠা, লাউ পায়েস, ছিট, সিদ্ধ, পুতুল, লরি, তারাজোড়া, জামাই, ঝুরি, বিবিয়ানা, খান্দেশা ইত্যাদি