রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৭ অপরাহ্ন
মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন বিশেষ প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম-আইনজীবী আলিফ হত্যা : সরানো হলো পুলিশের ডিসি-ওসিকে’হত্যাকাণ্ডে ২৫ জন, লাশের ওপরও চলে নির্মমতা- আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মিশনে ২৫ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর করা ভিডিও ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩ জনই কোতোয়ালি থানার বান্ডেল সেবক কলোনির বাসিন্দা। সেবক কলোনিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বসবাস করেন। সেবক কলোনির পাশেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ঘটনার পর আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের নাগাল পায়নি পুলিশ।
কোপানো ও পেটানোর পর নিথর হয়ে পড়ে ছিল আলিফের দেহ। তাঁর শরীরে অন্তত ৩০টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গভীর ক্ষত রয়েছে পাঁচটি। এতে তাঁর ডান কানের একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর ৩৭ অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে আলিফ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, নিন্দা ও বিচার দাবিতে গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, বিক্ষোভ ও বিচারকদের কর্মবিরতি পালনের খবর পাওয়া গেছে। এসব কর্মসূচি থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ইসকনকে নিষিদ্ধেরও দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যাতে বিনষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো নয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগে নানা শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক-সামাজিক-
সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভারও আয়োজন করা হয়। নিথর দেহকেও রেহাই দেয়নি খুনিরা তদন্তকাজে যুক্ত পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রঙ্গম কনভেনশন হলের পাশে এসি দত্ত লেনে শুরুতে ইটপাটকেল ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে জড়ো হয় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীরা। এক পর্যায়ে ধাওয়া দিয়ে চিন্ময় অনুসারীদের এসি দত্ত লেনের শেষ মাথায় নিয়ে যান আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ। পরে সেবক কলোনি থেকে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন বের হয়ে পাল্টা ধাওয়া দিলে আইনজীবীরা গলি থেকে পেছনে সরে আসেন। এ সময় নিলয় সুজন ভবনের পাশে পা মচকে পড়ে যান আইনজীবী আলিফ। তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন লাঠিসোটা, কাঠের বাটাম দিয়ে পেটানো হয়। রক্তক্ষরণ ও পিটুনিতে নিথর হয়ে যাওয়ার পরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁকে কোপ দিতে দেখা যায় সেবক কলোনির চন্দন ও বুঞ্জাকে।কিলিং মিশনে যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা হলো– কোতোয়ালি থানার বান্ডেল সেবক কলোনির নাং কিশোরের ছেলে বিধান, পেয়ারের ছেলে রনব, জগন্নাথ দাস ঝর্ণার ছেলে বিশাল ও বিকাশ, সেবক কলোনির রাজকাপুর, মোহনের ছেলে লালা, মাধের ছেলে সামির, সেবক কলোনির সোহেল দাস, শংকরের ছেলে শিব কুমার, সেবক কলোনির বিগলাল, মুকেশের ছেলে পরাশ, শেরীপের ছেলে গণেশ, লাবু লাল সরদারের ছেলে ওম দাস, দোশীর ছেলে পপি, সুরেশের ছেলে অজয়, সেবক কলোনির দেবী চরণ, শেরীপের ছেলে দেব, মৃত ধারীর ছেলে চন্দন, বিহারির ছেলে জয়, মনোরঞ্জনের ছেলে রমিত, মনছুরের ছেলে বুঞ্জা, সেবক কলোনির লালা, আশরাফ আলী রোডের সেবা সংঘ এলাকার ওমকার দাস, নন্দনকানন ১ নম্বর গলির মৃত খোকনের ছেলে রুবেল সাহা ও পটিয়া উপজেলার ধলঘাট আলমপুর গ্রামের কালীবাড়ির শুভ কান্তি দাস।
দুটি ছবিতে সিলভার রঙের হেলমেট, কমলা রঙের টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা রামদা হাতে এক যুবক এবং লাল হেলমেট, ব্লু রঙের টি-শার্ট ও জিন্স পরা বঁটি হাতে আরেক যুবককে কোপাতে দেখা যায় আলিফকে। সে সেবক কলোনির মৃত ধারীর ছেলে চন্দন বলে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। অন্যজন মনছুরের ছেলে বুঞ্জা মেথর। তদন্তে যুক্ত এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ২৫ জনকে শনাক্ত করেছি। তাদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদে আনা হলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হবে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, নাকি তাৎক্ষণিক ঘটেছে– তাও বের করা সম্ভব হবে।’ শরীরে ৩০ ক্ষত আলিফের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিতে যুক্ত এবং উপস্থিত লোকজনের তথ্য অনুযায়ী, আলিফের পিঠে ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের পাঁচটি গভীর ক্ষত রয়েছে। এ ছাড়া আঘাতের ক্ষত রয়েছে ৩০টির অধিক। ময়নাতদন্তে সহায়তাকারী এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাথায় ধারালো অস্ত্রের তিনটি গভীর ক্ষত আছে। তাঁর ডান কানের একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় উপস্থিত থাকা নিহতের বন্ধু আইনজীবী রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘তাঁর শরীরের এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে ক্ষত হয়নি। তাঁকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষতস্থানগুলো কালো হয়ে আছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’ গ্রেপ্তার আরও ১০, হয়নি হত্যা মামলা
চিন্ময় অনুসারী আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলেন– জুয়েল দাস, আব্দুল কাইয়ুম, রাজীব ভট্টাচার্য, জাহিদ হোসেন, রবি দাস, কৌশিক চৌধুরী, আবির দে, রবিন দে ও রুবেল দাস। তাদের সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আদালতে তোলা হলে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুরের পর নগরের আদালত এলাকা, কোতোয়ালি মোড় ও রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের হলেও আইনজীবী হত্যায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের হয়নি। মামলা নেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষায় আছে পুলিশ। আলিফের বাবা জামাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, ‘এখনও মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন আসলে কোনো বিষয়ে কথা বলার অবস্থায় নেই কেউ। আরও কয়েকটা দিন যাক, এরপর পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) কাজী তারেক আজিজ সমকালকে বলেন, ‘হত্যা মামলা নেওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষায় আছে পুলিশ।’ কোতোয়ালি থানার ওসিকেও বদলি
চিন্ময়কাণ্ডে কোতোয়ালি থানার ওসি ফজলুল কাদের চৌধুরীকেও বদলি করা হয়েছে। তাঁকে ডিবি বন্দরে পাঠিয়ে নতুন ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নগর পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক আবদুল করিমকে। গতকাল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ এ আদেশ দেন। এর আগে বুধবার রাতেই সিএমপি দক্ষিণ জোনের উপকমিশনার লিয়াকত আলী খানকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে বদলি করা হয়। চট্টগ্রাম আদালতে কর্মবিরতি
আলিফ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছেন চট্টগ্রামের আইনজীবীরা। কর্মবিরতির কারণে ৭৪টি আদালতে বিচারিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়নি। আদালতপাড়ায় খুনিদের বিচার চেয়ে মিছিল ও মানববন্ধন করেছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামসহ কয়েকটি সংগঠন। তারা আসামিদের পক্ষে না দাঁড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। ইসকন নিষিদ্ধ করতে স্লোগান দেন আইনজীবীরা। ওই দিনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। একই দাবিতে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ এদিকে গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে আইনজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার সংগঠন। ইসকন নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলামী পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলাম এবং ফেনী, রাঙামটিসহ বিভিন্ন স্থানে আইনজীবীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে রংপুর জেলা পুলিশ।