বাংলাদেশ প্রতিদিন খবর
- শনিবার ২০ আগস্ট, ২০২২ / ২১৫ জন দেখেছে
আজ ২০শে আগস্ট। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আজকের এই দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, কিংবদন্তি বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান শাহাদত বরণ করেন।১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে এসেছিলেন।
২৫ মার্চের কালরাতে তিনি ছিলেন তাদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরের রামনগর গ্রামে। হানাদারদের পৈশাচিক গণহত্যা দেখে আর তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। ভাবলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু করার। তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হওয়া সত্ত্বেও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন। তিনি যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুললেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী।
১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ‘সেভর জেড’ বিমান থেকে তাদের ঘাঁটির ওপর বোমাবর্ষণ করে। পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন মতিউর রহমান। তাই ঘাঁটি পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তার বাহিনী।
বিমান আক্রমণ শেষে তিনি সবার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বিমান থেকে ভৈরবে বোমাবর্ষণ হয়েছে। পাইলটদের মাঝে এমনও হতে পারে কেউ আমার ছাত্র। আমারই ছাত্র আজ আমার মাথায় বোমা ফেলছে। আমার দেশকে রক্তাক্ত করছে।’ মাটি হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মাটির মর্যাদা আমি রাখবই। আমি পাইলট। আমার চাই যুদ্ধবিমান। একটা বিমান পেলে তাদের দেখিয়ে দিতাম। কারণ বিমান প্রতিহত করতে চাই বিমান বা বিমান বিধ্বংসী কামান।’
৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান। যদিও দুই মাসের ছুটিতে এসে চার মাস পেরিয়ে গেছে ততদিনে। করাচি পৌঁছে লক্ষ্য করেন বাঙালি অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাকেও তার নিজের দায়িত্ব না দিয়ে দেওয়া হলো ফ্লাইট সেফটি অফিসারের দায়িত্ব। মতিউর রহমানের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের। তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন। সহকর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর খুঁজছেন সুযোগ।
পিআইএ’র একটি বিমান হাইজ্যাকের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বাঙালি অফিসারদের ওপর কড়া নজর রাখা শুরু হয়। বাঙালি পাইলটদের আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি বাতিল করা হয়। তখন করাচির মাশরুর বিমান ঘাঁটির বেস ফ্লাইট সেফটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মতিউর রহমানকে। অথচ এর আগে তিনি ছিলেন ফ্লাইট ইন্সট্রাকটর তথা বিমান প্রশিক্ষক। ছাত্রদের বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। তার অনেক পাকিস্তানি ছাত্রের একজনের নাম রশিদ মিনহাজ। রশিদ মিনহাজ পুরাতন ছাত্র বলে বুঝেছিলেন সে (মিনহাজ) একা আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি পাবে। তাই তাকেই টার্গেট করেছিলেন মতিউর রহমান।ঘটনার দিন ২০ আগস্ট ১৯৭১, শুক্রবার।
ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী মিনহাজের উড্ডয়ন আজ। মতিউর পূর্ব পরিকল্পনা মতো অফিসে এসে সঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে। সামনে পিছনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩ যুদ্ধ বিমান। রশিদ মিনহাজ বিমানের সামনের সিটে বসে স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসছে। এবার মতিউর রহমানের পালা। মতিউর রহমান হাত তুলে বিমান থামালেন। হাতের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন, বিমানের পাখায় সমস্যা। রশিদ মিনহাজ বিমানের ‘ক্যানোপি’ খুলতেই তাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে বিমানের পেছনের সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন মতিউর রহমান। কিন্তু জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ বলে ফেললেন, ‘আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাকড’।
ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার শুনতে পেল তা। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর রহমান বিমান নিয়ে ছুটে চললেন। রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে অনেক নিচ দিয়ে বিমান চালাচ্ছিলেন তিনি। যদিও ততক্ষণে এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান ও একটি হেলিকপ্টার তাকে ধাওয়া করা শুরু করে কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশে।
বিমানটি যখন ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে তখন রশিদ মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি বাধা দিতে চেষ্টা করেন। সীমান্ত থেকে মাত্র দুই মিনিট দূরত্বে সিন্ধু প্রদেশের জিন্দা গ্রামে বালির ঢিবির ওপর আছড়ে পড়ে ব্লু বার্ড-১৬৬।
বিধ্বস্ত হয় টি-৩৩ যুদ্ধবিমান। মতিউর রহমানের সঙ্গে প্যারাসুট না থাকায় তিনি শহীদ হন। তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে। বিমান ছিনতাইয়ের স্বপ্ন সফল হলো না।বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কল্পনায় ছিল কীভাবে মুক্ত হবে মাতৃভূমি। তাই তো দেশের পানে ছুটে ছিলেন নিজের প্রাণ হাতে রেখে। নিজের জীবনকে বিলিয়ে গড়েছেন মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার নজিরবিহীন ইতিহাস।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের মরদেহ দাফন করা হয়েছিল বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। আর রশিদ মিনহাজ চিহ্নিত হয়েছিলেন জাতীয় বীর হিসেবে। ভূষিত হয়েছিলেন মরণোত্তর নিশান-ই-হায়দার খেতাবে। যা পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। দীর্ঘ ৩৫ বছর শত্রুভূমি পাকিস্তানের মাটিতে তার কবর পড়েছিল অবহেলা আর অনাদরে।
রশিদ মিনহাজের কবরের সামনে উর্দুতে লেখা ‘ফরোয়াজে দোন কি এক ফেজা মে মুমিন কা নিশা আওর মুনাফিককা নিশা, আওর রাশিদ কি শাহাদত ইয়ে হ্যায়।’অর্থাৎ ‘মুসলমান ও মুনাফিকের চিহ্ন আলাদা, যদিও একই ভূমিতে তাদের বিচরণ। রশিদের শহীদ হওয়া ছিল কবি ইকবালের এই কবিতার মতো।’
নিচে কবি ইকবালের ফার্সি ভাষায় লেখা একটি কবিতা ‘কুরগেজ কা জাহা আওর হায় শাহী কা জাহা আওর’। যার অর্থ ‘শকুন ও বাজপাখির বিচরণ একই স্থানে হলেও তাদের স্থান আলাদা’। একটু দূরেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের কবরের সামনে লেখা ছিল ‘ইধার সো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’ বা ‘এখানে ঘুমিয়ে আছে এক বিশ্বাসঘাতক’।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের ‘মোবারক লজ’-এ ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল নরসিংদীর রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুনের ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ডিসটিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন মতিউর রহমান। ১৯৬৩ সালে রিসালপুর পি.এ.এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করার পর করাচির মৌরিপুর (বর্তমান যা মাসরুর নামে পরিচিত) এয়ার বেজের দুই নম্বর স্কোয়ার্ডনে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি। বিমান বাহিনীর ক্যারিয়ারে প্রতিটি পদে তিনি রেখেছিলেন তার যোগ্যতা ও মেধার ছাপ। মৌরিপুরে টি-৩৩ জেট বিমানের ওপর একটি বিশেষ কোর্সে তিনি পেয়েছিলেন শতকরা ৭৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ নম্বর। এরপর এফ-৮৬ স্যাবর জেটের ওপরও একটি বিশেষ কোর্সে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। বৈমানিক কনভার্সন কোর্সে তার অসাধারণ মেধা দেখে তাকে পেশোয়ারের ১৯ নম্বর স্কোয়ার্ডনে পোস্টিং দেওয়া হয়।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন মতিউর রহমান। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে অসীম দক্ষতার সঙ্গে প্যারাসুটের মাধ্যমে মাটিতে অবতরণ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন মতিউর রহমান। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দুই বছর ফ্লাইং প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ সালে তাকে বদলি করা হয় জেট ফ্লাইং প্রশিক্ষক হিসেবে।
ঠিক আজ থেকে ৫১ বছর আগে আজকের দিনে মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। প্রিয় মতিউর থাকবেন বাংলায় প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি স্পন্দনে।কিংবদন্তি বীরশ্রেষ্ঠের মতিউর রহমান এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নাগরপুর উপজেলা শাখা।
এ বিষয়ে নাগরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের বিপ্লবী সংগ্রামী সভাপতি, উপজেলা আওয়ামী নেতৃবৃন্দদের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল, মেধাবী ব্যক্তিত্ব, তরুন নেতৃত্ব জননেতা আলহাজ্ব জাকিরুল ইসলাম উইলিয়ামের সাথে গণমাধ্যমের কথা হয়।
তিনি গণমাধ্যমকে জানান- বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব। তিনি সহ সকল খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে বাংলার বীর শহীদ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা নক্ষত্রের মতো প্রজ্বলিত থাকবে।
আমি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান সহ যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং যার ডাকে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতার আত্মার প্রতি শান্তি এবং মাগফেরাত কামনা করছি।
এরপর নাগরপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের বিপ্লবী সংগ্রামী সফল সাধারণ সম্পাদক, নাগরপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তিন তিনবার নির্বাচিত নৌকা মার্কার একমাত্র সফল চেয়ারম্যান, বর্তমান সময়ে নাগরপুর উপজেলায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে জননেতা মো: কুদরত আলী গণমাধ্যমকে বলেন- বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান আমাদের অহংকার এবং গর্ব। স্বাধীনতার জন্য মতিউর রহমান সহ যে সকল বীর শহীদ এবং খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদেরকে অস্বীকার করার মতো সুযোগ আমাদের কারো নেই।
আমি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান সহ যে সকল বীর শহীদ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের সকলের এবং স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতি শ্রদ্ধা এবং আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করছি।