শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন
মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন বিশেষ প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম নগরের জনসংখ্যা অনুপাতে পার্ক ও খেলার মাঠ থাকার কথা অন্তত ৭০০টি বেশি। বর্তমানে নগরে খেলার মাঠ ও পার্ক আছে মাত্র ১৯৫টি। এর মধ্যে পার্ক ছিল পাঁচটি। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাধীনতা পার্ক ও আগ্রাবাদ কর্ণফুলী পার্ক তালাবদ্ধ। এখন শিশুদের জন্য খোলা নেই একটিও বিনোদন কেন্দ্র।
ফলে ছাদের নিচে বিভিন্ন রেস্তোরাঁর কোণে কোণে গড়ে উঠছে শিশু জোন। উপায়ন্তর না দেখে সেখানে শিশুদের নিয়ে যাচ্ছেন মা-বাবা। ক্রিকেট-ফুটবল ভুলে শিশুরা যন্ত্রনির্ভর বিনোদনে অভ্যস্ত হচ্ছে। বাড়ছে মোবাইল আসক্তি। পাশপাশি শিশুরা ফাস্টফুডে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এতে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নগরায়ণের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। ঘটছে শিল্পের সম্প্রসারণ। খোলা জায়গা, মাঠ, নদী ও খালগুলো দখল করে তৈরি হচ্ছে আবাসন প্রকল্প আর শিল্পকারখানা। এতে দিন দিন কমছে খেলার মাঠ ও পার্ক। বর্তমানে নগরের পাঁচটি পার্কের মধ্যে এখন চারটিই বন্ধ।
এর মধ্যে দুটি বন্ধ হয়েছে ৫ আগস্টের পর। শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা কিংবা বয়স্কদের হাঁটাহাঁটির জন্য এসব পার্ক বেশ পরিচিত জায়গা ছিল। সেগুলো এখন আর আগের চেহারায় নেই। তার চেয়ে বড় কথা, অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। নগরের বাসিন্দারা বলছেন, আওয়ামী আমলে ক্ষমতাসীনদের লুটপাটসহ নানা অজুহাতে পার্কগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।
এতে শিশুদের বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটছে। এভাবে মাসের পর মাস বন্ধ রাখার সুযোগে এসব পার্ক হারিয়ে যাবে। পরে দেখা যাবে সেখানে নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। নগর পরিকল্পনার মানদ- অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরের জনসংখ্যার অনুপাতে পার্ক ও খেলার মাঠ থাকার কথা অন্তত ৭০০টি। বর্তমানে নগরে খেলার মাঠ আছে ১৯৫টি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তালা ঝুলছে চট্টগ্রামের অন্যতম দুই পার্ক চান্দগাঁওয়ের স্বাধীনতা কমপ্লেক্স ও আগ্রাবাদের কর্ণফুলী শিশুপার্কে। এর আগে থেকে বন্ধ রয়েছে কাজীর দেউড়ি এলাকায় অবস্থিত শিশুপার্ক। দুই নম্বর ষোলশহর এলাকায় বিল্পব উদ্যানটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ধ্বংস করে ফেলেছে সিটি করপোরেশন। গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ থাকার পর গত ৩ জানুয়ারি নতুন নামে ফিরেছে পাঁচলাইশের জাতিসংঘ পার্ক। স্থানীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে শিশু-কিশোরদের জন্য পার্ক ছিল মাত্র তিনটি। এর মধ্যে গত বছরের শেষের দিকে কাজীর দেউড়ির শিশুপার্কটি সিলগালা করে দেয় জেলা প্রশাসন। এরপর সেটি ভেঙে ফেলা হয়। এ অবস্থায় আগ্রাবাদের কর্ণফুলী শিশুপার্ক ও চান্দগাঁওয়ের স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্ক ছিল শিশুদের বিনোদনের স্থান। পার্ক দুটির প্রথমটি গণপূর্ত বিভাগের এবং অন্যটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন।
গত ৫ আগস্ট থেকে এ দুই পার্কেও তালা ঝুলছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে আত্মগোপনে রয়েছেন পার্কের ইজারাদাররা। ৫ আগস্ট লুটপাট চালানো হয় স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্কে। এরপর হামলার ভয়ে কর্ণফুলী পার্কে তালা দেয় কর্তৃপক্ষ। দুটি পার্ক পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ। ফলে চট্টগ্রাম নগরে এখন শিশুদের আর কোনো বিনোদনকেন্দ্র নেই। জেলা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের হিসাবে, চট্টগ্রাম নগরে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা প্রায় আট লাখ। এর মধ্যে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি। বিপ্লব উদ্যান : নগরের ২ নম্বর গেটের ষোলশহর এলাকায় অবস্থিত বিপ্লব উদ্যানটি এখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর লোভের বলি হয়েছে এই উদ্যানটি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মরণে ১৯৭৯ সালে উদ্যানটি নির্মিত হয়। যার নাম রাখা হয় বিপ্লব উদ্যান। নগরের সবুজ উদ্যানটিতে প্রথম আঘাতটি করা হয় ২০১৮ সালে। ওই বছর ১ নভেম্বর স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড ও রিফর্ম লিমিটেড নামে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সিটি করপোরেশন।
বিপ্লব উদ্যানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ২০ বছর মেয়াদি এক চুক্তির পর উদ্যানে গড়ে তোলা হয় ইট-কংক্রিটের অবকাঠামো। বিপ্লব উদ্যান ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষায় চট্টগ্রামের পরিবেশবিদরা মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিপ্লব উদ্যানের কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই এটার ডিজাইন করা হবে।’ কর্ণফুলী শিশুপার্ক : নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় পার্কটির অবস্থান। ১৯৯২ সালের ২১ মে গণপূর্ত অধিদফতরের কাছ থেকে ৮ দশমিক ৮৬ একর জায়গা বরাদ্দ নেয় সিটি করপোরেশন। আট বছর পর ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বর শিশুদের বিনোদনকেন্দ্র তৈরির জন্য সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ২৫ বছরের চুক্তি করে আনন্দ মেলা লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটি নগরের আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠের পাশে কর্ণফুলী শিশুপার্ক নামে শিশুদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলে। ২০২৫ সালে শেষ হবে ইজারা চুক্তি। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এটি বন্ধ রয়েছে। পার্কের নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনেই পার্কটি বন্ধ রেখেছেন তারা। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর ইজারাদার প্রকাশ্যে আসেননি।
এ বিষয়ে এস্টেট শাখাকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্ক : একসময় এ পার্কের নাম ছিল শহীদ জিয়া কমপ্লেক্স। ২০০৬ সালে নাম পরিবর্তন করে ১১ একর জায়গার ওপর বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনার রেপ্লিকা নিয়ে নগরের চাদগাঁওয়ে তৈরি করা হয় স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। সংসদ ভবন, শহিদ মিনার, সোনা মসজিদ, কান্তজিউ মন্দির, আহসান মঞ্জিল, সুপ্রিম কোর্ট ও স্মৃতিসৌধের রেপ্লিকা রয়েছে পার্কটিতে। এ ছাড়া ১৫টি বেশি রাইড, ছোট-বড় রেস্তোরাঁ ছিল পার্কের ভেতরে। এর মূল আকর্ষণ ছিল প্রায় ২০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে থাকা ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে পার্কের ইজারা পান চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন। সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে।ফলে এটি আর খোলা হয়নি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম স্বাধীনতা কমপ্লেক্স পার্ক পরিদর্শন করেছেন। এটি চালুর জন্য একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এ ছাড়া কাজীর দেউড়ি পার্কের স্থানে শিশুবান্ধব কিছু করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম শিশুপার্ক : ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর নগরের কাজীর দেউড়ির শিশুপার্কটি সিলগালা করে দেয় জেলা প্রশাসন। এরপর সেটি ভেঙে ফেলা হয়। পার্কের জমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সিটি করপোরেশন জমিটি লিজ নিয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশনকে যেসব শর্তে জমিটি ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল, তার ব্যত্যয় ঘটায় ইজারা বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে এই পার্কের জমিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিজয় মেলা। জাতিসংঘ পার্ক এখন জুলাই স্মৃতি পার্ক : দীর্ঘ ১৩ বছর বন্ধ থাকার পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন জাতিসংঘ পার্ক। ৩ জানুয়ারি পার্কটির উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তবিষয়ক উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। পার্কটির নতুন নাম রাখা হয়েছে ‘জুলাই স্মৃতি উদ্যান’। নগরের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় অবস্থিত পার্কটি। ১৯৬৪ সালে ২ দশমিক ১৭ একর জমিতে গড়ে উঠেছিল এটি। এতে চার কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি সুইমিংপুল তৈরি করা হয়। পুলগুলোকে পার্ক থেকে আলাদা করার জন্য সীমানাপ্রাচীর দিয়ে পার্কটিকে অর্ধেক করে ফেলা হয়। পরে পার্কের পুলের পানিতে ডুবে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে পুলগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পার্কের সংস্কারকাজ শুরু হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরে জনসংখ্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত খেলার মাঠ-পার্ক নেই। আমার ইচ্ছা নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ, ওয়ার্কিং স্পেস ও শিশুপার্ক গড়ে তুলব। যেসব বন্ধ পার্ক আছে সেগুলো খুলে দেওয়ার কাজ চলছে। বিপ্লব উদ্যান বিগত মেয়রদের লোভের বলি হয়েছে।
এ কারণে ধ্বংস করে দিয়েছে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাতে পুনরায় পার্ক হবে।’চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরে যে পরিমাণ খেলার মাঠ-পার্ক থাকার কথা ছিল, তা নেই।
যেগুলো আছে সেগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বিপ্লব উদ্যান ভেঙে স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও সিডিএ থেকে কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অবশ্যই আমাদের উন্মুক্ত পরিসর, খেলার মাঠ ও উদ্যানের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’