শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০২ অপরাহ্ন
টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরসভার তামাকপট্টি এলাকার মো. আসলাম ও নূরজাহান দম্পতির ছেলে মো. শাহিন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও ছোট থেকেই অনেক মেধাবী তিনি। বাবা মুদি দোকানি। মা সংসারের পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ করেন। পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজ করে উপার্জিত টাকা শাহিনের পড়াশোনায় খরচ করেছেন। শাহিন ও ছোট থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি বাবার মুদি দোকান সামলাচ্ছেন। তবে তার করা এত বছরের কষ্ট লাঘব হয়েছে। ৪০তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে মেধা তালিকায় ১৭তম হয়েছেন শাহিন। সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে।
জানা গেছে, চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে শাহিন তৃতীয়। ২০১০ সালে গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে দাখিল পাস করেন। এরপর গোপালপুর কলেজ থেকে ২০১২ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করে ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ২০১৭ সালে কৃষি অনুষদ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে অনার্স শেষ করেন। সেখান থেকেই উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন প্রথম বিভাগে।
সরেজমিনে শাহিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাবার দোকানে বসে দোকানদারি করছেন শাহিন। দোকানে আসা ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করছেন। এর ফাঁকে ফাঁকে বই পড়ছেন। তাদের জরাজীর্ণ বসবাসের একটি ঘরের সামনের অংশে দোকান। পেছনের অংশে তাদের পড়াশোনার কক্ষ। আরেক থাকার কক্ষে মা নূরজাহান সেলাইয়ের কাজ করছেন। একসঙ্গে লাগানো দুটি পড়ার টেবিলে তারা তিন ভাই-বোন পড়াশোনা করেন। তাদের বাবা স্ট্রোক করায় এখন আর তেমন কাজ করতে পারেন না, ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না।
স্থানীয় নূরে আলম বলেন, ‘পরিবারটি খুবই অসহায়। তবে সন্তানরা পড়াশোনায় ভালো থাকায় তাদের বাবা-মা কঠোর পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করে সংসার চালানোর পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। জমিজমা বলতে একটি ঘর ছাড়া তাদের কিছুই নেই। মা নূরজাহান সেলাইয়ের কাজ করেন। ওই ছোট্ট দোকান ও মায়ের উপার্জন দিয়েই চলে তাদের সংসার।’ স্থানীয় তোষক ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘শাহিন ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, শাহিন সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে দোকানদারি করেছে এবং পরিবারকে সহায়তা করেছে।’
স্থানীয়রা জানান, শাহিন লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে দোকানদারি করেছে। আমরা দেখেছি সে দোকানে বেচা-কেনার পাশাপাশি বই পড়েছে। এখনও বাড়িতে আসলে দোকানে বসে। তার বিসিএস হওয়ার পেছনের গল্প খুবই করুণ। এই পরিবার থেকে কেউ বিসিএস ক্যাডার হবে এটা কল্পনাও ছিল না।
শাহিনের বড় ভাই তাওহীদ বলেন, ‘ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে ভাইরা দোকানদারি করেছি। বাবা এখন দোকান করতে পারেন না, তাই আমি দোকান চালাই। শাহিন বাড়িতে আসলে দোকানে বসে। ভাইদের মধ্যে সে খুব মেধাবী।’ শাহিনের মা নূরজাহান বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছি। সেলাই করে যে টাকা উপার্জন হতো সব টাকাই ছেলের পেছনে ব্যয় করতাম। যাতে সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। ছেলেও অনেক কষ্ট করেছে। মায়ের কষ্ট ছেলে লাঘব করেছে। মা হিসেবে আমি খুবই গর্বিত ও আনন্দিত।’
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত শাহিন বলেন, ‘আমার এই পর্যন্ত আসার পেছনে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি। মা তোষক, মশারি, লেপ সেলাই করে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে আমাদের ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। এছাড়াও ছোট দোকানের আয় থেকে কোনো মতে সংসার চলত। স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করার পাশাপাশি দোকানদারি করে বাবাকে সহায়তা করতাম।
তিনি আরো বলেন, ‘ময়মনসিংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তেমন দোকানে বসতে পারিনি। এর মধ্যে বাবা অসুস্থ হওয়ায় বড় ভাই দোকান চালান। যখন বাড়িতে আসতাম তখন দোকানে বসতাম। শৈশব ও কিশোরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। মা সব সময় সাহস যোগাতেন, বলতেন তুমি পারবে।’
গোপালপুর দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. শরাফত উল্লাহ বলেন, ‘শাহিনের সাফল্যে আমরা গর্বিত। এই মাদ্রাসা থেকে ভালো রেজাল্ট করে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। এতে শিক্ষকরা খুবই আনন্দিত।