বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২৪ পূর্বাহ্ন
মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন বিশেষ প্রতিনিধি:
গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ৩০ শতাংশ পানি অপচয় হওয়ায় রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। গত এক দশকে সংস্থাটির সিস্টেম লস বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যা ছিল ১৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম ওয়াসার বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, সংস্থাটি ২০২৩-২৪ সালে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৫১১ মিলিয়ন পানি উৎপাদন করলেও রাজস্ব আয় হারিয়েছে ৫২ হাজার ৯৬২ মিলিয়ন লিটার। এসব পানি নন-রেভিনিউ ওয়াটার (এনআরডব্লিউ) হিসেবে শ্রেণিভুক্ত ছিল।অর্থাৎ প্রতি হাজার লিটারে ১৯ দশমিক ৩৭ টাকা গড় শুল্কসহ, সংস্থাটি সম্ভাব্য রাজস্ব হারিয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি।এনআরডব্লিউ বা সিস্টেম লস বলতে এখানে হিসাবে ধরা হয়নি এমন পানির পরিমাণকে বোঝায়।রাষ্ট্রীয় চার পানি সরবরাহ সংস্থার মধ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসার সিস্টেম লসই সবচেয়ে বেশি।সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসার সিস্টেম লসের হার ছিল যথাক্রমে সাড়ে ১৭ শতাংশ ও ২৯ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে ঢাকা ওয়াসায় সিস্টেম লস ছিল ২০ শতাংশ।নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও পাইপলাইন প্রতিস্থাপনে ৬ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয় করা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার অপচয় বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে পাইপলাইনে লিকেজ, অবৈধ সংযোগ ও মিটারিংয়ে ত্রুটির কারণকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতির কারণ বলে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা।
ভোক্তা ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা মিটারিং পদ্ধতির কারসাজি করে পানি চুরির জন্য কিছু অসাধু ওয়াসার কর্মীকে দায়ী করছেন।অন্যদিকে অপচয়ের কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার ৮৯ হাজার ৫০৮ জন গ্রাহকের অনেকের কাছে পানি সরবরাহে তীব্র সংকটও দেখা দিয়েছে।বন্দর নগরীর সিমেন্ট ক্রসিং এলাকার বাসিন্দা হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘আমি সপ্তাহে একবার পানি পাই, কিন্তু তারপরও ন্যূনতম বিলিং পদ্ধতিতে প্রতি মাসে প্রায় ৬০০ টাকা বিল দিতে হয়।’পতেঙ্গার মকবুল আহমেদ সোসাইটি এলাকায় বসবাসকারী ফারুক হোসেন জানান, তার এলাকার মানুষ মাসে ৮-১০ বার পানি পায়।ফারুক বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে মাত্র ৮-১২ ইউনিট [১ ইউনিট = ১০০০ লিটার] পানি পাই, কিন্তু গড় বিলিং সিস্টেমের আওতায় আমাদের কাছ থেকে ৩০ ইউনিটের জন্য চার্জ করা হচ্ছে।’চট্টগ্রাম ওয়াসার রাজস্ব কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, অনেক গ্রাহকের কাছে বাস্তবে ব্যবহারের চেয়ে বেশি পানির জন্য বিল করা হচ্ছে।ভোক্তা অধিকার কর্মী এস এম নাজের হোসেন বলেন, ওয়াসার অদক্ষতার কারণে গ্রাহক অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হচ্ছে এতে করে তাদের ওপর আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের বলেন, ‘সিস্টেম লসের প্রভাব সরাসরি ভোক্তাদের ওপর পড়ে। এই লোকসান কমানো গেলে ওয়াসা আরও বেশি রাজস্ব আয় করবে এবং দাম বাড়ানোরও দরকার হবে না।’তিনি ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পানি চুরির জন্য মিটারে কারচুপির অভিযোগ আনেন।তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে সিস্টেম লস চলতেই থাকবে।চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম স্বীকার করে বলেন, মিটারিংয়ের ত্রুটিই পানি চুরির প্রাথমিক উপায়।তিনি বলেন, ‘দেশের সব পানি সরবরাহ সংস্থায় সিস্টেম লস হয়, তবে আমরা এটিকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে কাজ করছি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এনআরডব্লিউ স্ট্যান্ডার্ড ১৫ শতাংশ বলে জানান তিনি।পানির অপচয় কমাতে ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পের (ফেজ-১) আওতায় প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পুরোনো পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ৯১৯ কোটি টাকা ঋণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ঋণে ১ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম ওয়াটার সাপ্লাই ইমপ্রুভমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পুরনো পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২) এর আওতায় ৭০০ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রতিস্থাপনে ৩ হাজার ৮২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। জাইকা এজন্য ২ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা ঋণ দেয়।
২০১১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।তবে এতসব উন্নয়ন কাজের পরও পাইপলাইনে লিকেজের কারণে বছরে গড়ে ২৫ কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ৯০০ মিলিয়ন লিটার পানি অপচয় হচ্ছে।বড় ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করার পরও কেন অপচয় বাড়ছে জানতে চাইলে মাকসুদ বলেন, ‘পাইপলাইনে লিকেজ থেকে সিস্টেম লস হচ্ছে ৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে অন্যান্য সমস্যার কারণে যেগুলো সমাধান করা দরকার।’চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মুহম্মদ রশিদুল হাসান, দুর্বল পরিকল্পনাকে বিশাল পানি অপচয়ের জন্য দায়ী করেন।
‘চট্টগ্রাম ওয়াসা সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন পাইপলাইন বসিয়েছে, যার ফলে আবারও লিকেজ হয়েছে।’চট্টগ্রাম ওয়াসা বর্তমানে ১৩০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। তবে বন্দর নগরীর ৩৫-৪০ শতাংশ এলাকা এখনও পরিষেবা নেটওয়ার্কের বাইরে রয়ে গেছে।