বুধবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৬ পূর্বাহ্ন
মো. সেলিম উদ্দিন খাঁন
বাংলাদেশের দক্ষিণে কক্সবাজারের মহেশখালীর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের বুকে ছোট্ট এক দ্বীপ—সোনাদিয়া। আয়তনে মাত্র সাত বর্গকিলোমিটার, অথচ সৌন্দর্যে যেন অগণিত পৃথিবীর সংমিশ্রণ। একদিকে বিস্তীর্ণ বালুচর, অন্যদিকে লাল কাঁকড়ার দল, মাঝখানে ঝিরঝিরে বাতাসে ভেসে আসে সমুদ্রের নোনাধার গন্ধ। যারা প্রকৃতি ভালোবাসে, শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে শান্তি খোঁজে—তাদের জন্য সোনাদিয়া এক নিখুঁত আশ্রয়। কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এর অবস্থান। এক সময় সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার বিচরণ ছিল। ছিল গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা মা কচ্ছপের বিচরণ। প্যারাবনে বিলুপ্ত প্রজাতির চামচঠুঁটো (স্যান্ডপাইপার) পাখিসহ শত প্রজাতির পাখির মেলা বসত। এখন এর কিছুই নেই। সম্প্রতি এই দ্বীপের রূপবৈচিত্র্য ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ‘প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু সহনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বিশেষ আগ্রহে এ উদ্যোগ। এ প্রকল্পের আওতায় সোনাদিয়া দ্বীপে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। খালের মুখ ও শাখা-প্রশাখার বাঁধ অপসারণ করা হবে। জোয়ারের পানি প্রবাহের পথ খোলা রাখা হবে। বালিয়াড়ি পুনরুদ্ধার করে সৈকত সংরক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি রোপণ করা হবে ম্যানগ্রোভ ও নন-ম্যানগ্রোভ গাছের চারা– কেওড়া, কেয়া, নিশিন্দা, নারকেল ও তালগাছ। পরিদর্শন দলের সঙ্গে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহমুদ পাশা সমকালকে বলেন, কীভাবে দ্বীপের হারিয়ে যাওয়া পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ফিরে আসবে, সে চেষ্টা করা হচ্ছে। স্থানীয়দের মানোন্নয়নে কী করা যায়, সে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। এসব পরামর্শের আলোকে সরকার কাজ করবে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, এত সুন্দর একটা দ্বীপ চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। সরকার দ্বীপ রক্ষায় বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এক সময় এই দ্বীপে ছিল ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৫২ প্রজাতির শামুক, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ৯ প্রজাতির চিংড়ি, ২০৭ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং পরিবেশ বিনষ্টে অনেক কিছুর বিলুপ্তি ঘটেছে। হুমকিতে আছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য। সোনাদিয়ায় কাজ করা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ূম জানান, ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ এই দ্বীপে বছরে ১০ হাজারের বেশি ডিম পাড়ত। গত বছর সৈকত থেকে ডিম সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় এক হাজার। সৈকতজুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে থাকায় গভীর সমুদ্র থেকে ছুটে আসা মা কচ্ছপ ডিম পাড়ার পরিবেশ হারাচ্ছে। তা ছাড়া নির্জন এই দ্বীপে পর্যটকের আনাগোনা এবং রাতযাপনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, তিন যুগ আগে সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য ইতোমধ্যে ৯০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। সোনাদিয়া দ্বীপ রক্ষায় সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন পরিবেশ সংগঠনের নেতারা। ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বলেন, পৃথিবীতে যে ৩০০-এর মতো চামচঠুঁটো কাদাখোঁচা (স্যান্ডপাইপার) পাখি আছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশ দেখা যায় সোনাদিয়ার প্যারাবনে। এ বন উজাড় করে চিংড়িঘের নির্মাণ করায় চামচঠুঁটোসহ অন্যান্য পাখির বিচরণ এখন আর চোখে পড়ে না। সবকিছু মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপ রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।