মোঃ সেলিম উদ্দিন খাঁন বিশেষ প্রতিনিধি:
চট্টগ্রাম নগরীতে আগে একশ টাকা দিয়ে ব্যাগভর্তি বাজার করবার পারতাম। এহন এই টাকা দিয়ে বাজার করলে ব্যাগের কোণাও ভরে না।
সারা দিনে যে টাকা রোজগার করি সব টাকা বাজারেই খরচ হইয়া যায়। সংসার আর চালাইবার পারতেছি না। দিন যত যাইতাছে, ততই সংসার চালাইতে কষ্ট হইতাছে।
নিত্যপণ্যের অস্থির বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই! ‘পরিবারের চাহিদা পাঁচটি সবজি, কিন্তু কিনতে হচ্ছে দুটি বা তিনটি। যা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।
এক সপ্তাহ দূরে থাক, দুদিন কোনো রকমে চলে’-কথাগুলো বলেন নগরীর হালিশহর এলাকার ইসমত জাহান । একই এলাকার মামুনুল হক বলেন, সমস্ত সংস্কার পরে, এই মুহূর্তে প্রধান কাজ বাজার নিয়ন্ত্রণ।
খবরের কাগজে দেখলাম রাজশাহীতে পিস হিসেবে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু পিছ প্রতি দাম ২০০ টাকা। তাহলে আর কেটে বিক্রি করে কী লাভ। আগ্রাবাদ এলাকার রহিমা বেগম বলেন, ‘সকাল ১০টায় বাজারে এসেছি, ঘুরছি তো ঘুরছি। কোথায় একটু কমে নিত্যপণ্য মিলবে তার খোঁজে দেড় ঘণ্টা কেটে গেলো’।
আগ্রাবাদ কর্ণফুলী মার্কেট এলাকার বশিরুজ্জামান আকাশ বলেন, ‘সাধারণের কাছে আমিষ এক স্বপ্ন। সস্তার আমিষ ডিমও নাগালের বাইরে। চড়া দামের কারণে মনমতো সবজিও কেনা যাচ্ছে না। নাভিশ্বাস উঠে গেছে সাধারণ মানুষের’! আমিষ বা নিরামিষ কোথাও স্বস্তি নেই।
নিত্যপণ্যের বাজার এক মূর্তিমান আতঙ্ক যেন সাধারণ মানুষের কাছে। কোনো নিত্যপণ্যই সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। এতদিন আমিষ ছেড়ে যে নিরামিষে নির্ভর করতেন সাধারণ মানুষ, এখন সে সবজির বাজারও ধরাছোঁয়ার বাইরে। চাল, ডাল, আটা, চিনি, সয়াবিন তেলে তিন বছর যাবত অস্থিরতা বিরাজ করছে।
বিগত তিন বছর মৌসুমেও ইলিশ থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আলু, পেঁয়াজ, ডিম কিনে সংসার চালানো সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন হিসাব মেলাতে গিয়ে। চলতি সপ্তাহে আরও তিন টাকা বেড়ে ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা হালিতে।
সোনালী মুরগির ডিম ৬০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম ৬৪ টাকা, হাঁসের ডিম ৭২ টাকা এবং কোয়েল পাখির ডিম ১৪ টাকা হালি। ১২টি ডিমের বক্স ১৭০ টাকা। অবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণ চাইছেন ক্রেতারা। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি ফার্মগুলো থেকে পর্যাপ্ত ডিম ও মুরগি বাজারে না আসায় দাম কমছে না বলছেন আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতারা।ডিম ব্যবসায়ীরা বলেন, হাজার হাজার খামার বন্যায় ডুবেছে।
চাহিদার তুলনায় বাজারে ডিম ও মুরগির সরবরাহ কম আসছে, এ অবস্থা কাটতে সময় লাগবে।অন্যদিকে কাঁচামরিচে অব্যাহত বাড়তি দামের মাঝেই এ সপ্তাহে আরও বাড়লো। শনি রবি শহরের বড়বাজারে প্রতি কেজি কাঁচামরিচ বিক্রি হয় ৪৮০ টাকায়। যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয় ৩২০ টাকায়। বাজারে আগাম আসা শীতকালীন সবজিসহ সব ধরনের সবজি বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। সস্তার মুলাও বিক্রি হচ্ছে একশ’ টাকা কেজিতে। শিম বিক্রি হচ্ছে দুশ’ টাকা কেজিতে। ফুলকপি, টমেটো ১৮০, বাধাকপি ১২০ টাকা কেজি।
এক আঁটি পালং শাক বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। গাজর ১৮০ টাকা কেজি।অন্য সবজির মধ্য উচ্ছে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজিতে। করলা ৮০, বেগুন ১৬০, বরবটি ২০০, কাকরোল ১০০, লাউ ৭০ থেকে ১০০, ঢেড়স, চিচিঙ্গা, ওল ৮০ টাকা। কচুরলতি ১২০, কচুর মুখি ৬০, শসা ৬০ থেকে ৮০, ঝিঙ্গে, পটল ৭০, মিষ্টি কুমড়া ৫০, কাঁচকলা ৬০, ধুন্দল ৭০, পেঁপে ৪০ টাকা কেজি। এছাড়া, আলু ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে, চড়া মাংসের বাজার। ১০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে। ২০ টাকা বেড়ে সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৯০ টাকা কেজিতে। লেয়ার মুরগিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকায়। দেশি মুরগি ৫০০ টাকা। গরুর মাংস ৭০০ টাকা। খাসির মাংস এক হাজার ৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।এদিকে, সিন্ডিকেটের প্রভাবে ও প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে ইলিশের বাজারে অস্থিরতা কাটছে না।
১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আসছে ইলিশ ধরায়। তাই এ বছরও মৌসুমে স্বল্প দামে ইলিশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ক্রেতারা। শনি রবি শহরের বড় কর্ণফুলী মার্কেটে ইলিশ মাছ বিক্রি হয় ৮৫০ থেকে দুই হাজার ১২০০ টাকা কেজিতে।এক সপ্তাহ কিছুটা কম থাকার পরে আবারও বাড়লো পেঁয়াজের দাম।
পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে। যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয় ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে। রসুন ২২০ থেকে ২৮০ টাকা। আদা ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা। জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজিতে। এলাচ তিন হাজার ৫০০ টাকা। লবঙ্গ এক হাজার ৪৫০ থেকে দুই হাজার টাকা।
গোলমরিচ এক হাজার টাকা। দারুচিনি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি।মোটা ও চিকন সব ধরনের চাল বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। স্বর্না চাল ৫২ থেকে ৫৪ টাকা কেজি। আঠাশ ৬০ থেকে ৬২ টাকা। কাজললতা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। বাসমতি ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা কেজি।খোলা সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা লিটার। মুগ ডাল ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। মসুরের ডাল ১১০ থেকে ১৪০ টাকা। ছোলার ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। বুটের ডাল ৭৫ টাকা। খোলা আটা ৪০ টাকা। প্যাকেট আটা ৫০ টাকা। লবণ ৪০ টাকা। চিনি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদে বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটির বাজার তদারকি অভিযানে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) দুপুর ১২টার দিকে নগরের চৌমুহনীর সিডিএ বাজারে এই অভিযানে পরিচালনা করা হয়। এ সময় সঠিক মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় এসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়।
অভিযানে বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটির শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কর্মকর্তা, কৃষি বিপননের কর্মকর্তা, ক্যাবের সদস্যরাসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আগ্রাবাদ সার্কেল তানভির হাসান তুনান বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় টাস্কফোর্স কমিটি বাজার মনিটারিং করছে। মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করেছি।
আমার সঙ্গে ভোক্তা অধিকারসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার। আর ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান করব-তালিকা দেখে যাতে করে নিত্য প্রয়োজনী দ্রব্য কেনেন।’
ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, আগে থেকে ভোক্তা অধিকারের বাজার তদারকি অভিযান চলমান ছিল। শুরু থেকে আমরা মাঠে ছিলাম। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি।
এখন যৌথভাবে আমরা টাস্কফোর্স কমিটি অভিযান পরিচালনা করছি। বিভিন্ন অনিয়মে জরিমানার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ব্যবসায়ীদের সর্তকও করা হচ্ছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: বিল্লাল হোসেন
www.e.bdprotidinkhabor.com
Copyright By MOHAMMAD ASIF